আজকের দিনে প্রায় বিস্মৃত— কবি অরুণাচল বসুর জন্ম ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর (বাংলা
২৬ ভাদ্র ১৩৩০) অধুনা বাংলাদেশের যশোহর জেলার ডোঙ্গাঘাটা গ্রামে। পিতা শ্রী অশ্বিনীকুমার
বসু এবং মাতা সুলেখিকা সরলা বসু।
সবাইকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা
ছিল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ; ছোটো-বড়ো সবার সাথেই মিশতে পারতেন বন্ধুর মতো। সমসাময়িক প্রথিতযশা কবিদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন তাঁর
বন্ধুস্থানীয়। কিন্তু এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে কবির এই সংগ্রামী কর্মময় জীবনের
অবসান ঘটে মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে। অগণিত গুণগ্রাহীকে ফেলে রেখে— সেরিব্রাল থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের
২৪ জুলাই (বাংলা ৭ শ্রাবণ ১৩৮২) তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
কবির স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত এই ব্লগটির আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে তাঁর কথাই ধার করে বলি “এবার আবার মেলার গানে কণ্ঠ মিলাই”।
ছোটো থেকেই আঁকা এবং
লেখার প্রতি সহজাত প্রতিভা লক্ষ করা গেছিল তাঁর মধ্যে; মাত্র ছ-বছর বয়েসেই কবিতা লেখায় হাতেখড়ি।
বেলেঘাটার দেশবন্ধু হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে আলাপ অভিন্নহৃদয় বন্ধু
সুকান্ত ভট্টাচার্যের সাথে—
এর পরেই দুজনে একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠেন।
অল্পবয়সেই তিনি কমিউনিস্ট
আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন; প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে আসেন পার্টির বিভাজনের কিছু পরে।
তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা ও আপসহীন। এমনকি
জীবিকার ক্ষেত্রে যে ন্যূনতম আপস করতে হয়, তাও তিনি করেননি। তাঁর ডায়ারি থেকে জানা
যায় যে তিনি বহু ধরনের জীবিকাগ্রহণ করেছিলেন; কখনও ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় প্রুফ রিডারের চাকরি, কখনও ‘সোভিয়েত দেশ’
পত্রিকা ফেরি বা কখনও লন্ড্রি চালানোর প্রচেষ্টা— সকল রকম প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি তাঁর কবিসত্তাকে
অমলিন রেখেছিলেন। তাইতো তিনি লিখতে পারেন:
মেঘ না-হ’লে কি বিদ্যুৎ জমে
আকাশ কি হয় দীর্ণ—
ছিঁড়ে চলে যাবো, হোক না জীবন
কণ্টক
সমাকীর্ণ।
কবির জীবিতকালে মাত্র
দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল— ‘পলাশের কাল’ ও ‘দূরান্ত
রাধা’; এ ছাড়া ‘কবি কিশোর সুকান্ত’ (সরলা বসুর সাথে), ‘সুকান্ত : জীবন ও কাব্য’ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর কবিতায় যেমন ছিল
গীতিময়তা বা কাব্যমাধুর্য, তেমনই ছিল দেশাত্মবোধ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পলাশের কাল’ প্রসঙ্গে
সমালোচক বলেছিলেন: “সুকান্তর
সঙ্গী হয়েও অরুণাচলের কবিতা... সুকান্তর থেকে সুরে, শব্দে ও চিত্রে আশ্চর্য পৃথক।” প্রচুর গানও লিখেছিলেন তিনি।
অনুবাদক হিসাবেও তিনি
প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মূলত রাশিয়ান কবিতার অনুবাদ করলেও অন্যান্য দেশের
কবিতাও বাদ যায়নি। প্রায় সাঁইত্রিশ বছর ধরে রচিত তাঁর কাব্যচর্চার ফসল বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং পাণ্ডুলিপিতে ছড়িয়ে রয়েছে। এ ছাড়াও
রয়ে গেছে তাঁর আঁকা বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রচ্ছদ আর প্রচুর ছবি। মৃত্যুর প্রায়
সাতাশ বছর পরে তাঁর রচিত কবিতা, গান ও অনুবাদ নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে ‘অরুণাচল বসুর সংকলিত কবিতা’ নাম দিয়ে।
যে সমস্ত পত্রিকায়
তাঁর কবিতা প্রকাশ পেয়েছে, তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হ’ল: কিশোর সভা, কিশোর,
নতুন দিন, কবিতা, পরিচয়, সৃজনী, কবিকণ্ঠ, কেতন, দিগন্ত,
অগ্রণী, ডাক, প্রান্তিক, নান্দীমুখ, উত্তরসুরি, একক, নতুন সাহিত্য, সীমান্ত, রংমশাল, সঙ্কেত, পদাবলী, স্বাক্ষর, অভিমত, ইস্পাত, বাঙলা দেশ, কালান্তর,
রুশভারতী, প্রতীতি, অভিজ্ঞান, সোভিয়েত দেশ, প্রভৃতি।
বিভিন্ন সংকলনেও তাঁর
কবিতা স্থান করে নিয়েছে। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হ’ল:
·
হাজার বছরের প্রেমের কবিতা (১৯৬১) — সম্পাদনা : অবন্তী সান্যাল (তিনটি জাপানী কবিতার
অনুবাদ)
·
একালের কবিতা (১৯৬৩) — সম্পাদনা : বিষ্ণু দে (কবিতা: তুমি তো আকাশ আজ)
·
প্রেমের কবিতা (১৯৬৩) — সম্পাদনা : সুকুমার ঘোষ (কবিতা: কত নীল রাত হাওয়ায় হারালো)
·
মৌন মিছিল (১৯৬৬) — সম্পাদনা : সুবোধ রায়, খাদ্য আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে
নিবেদিত (কবিতা: এত জলে)
·
সেরা রংমশাল (২০০৩) —
সম্পাদনা : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (কবিতা: গান ও তীর)
তাঁর আর একটি পরিচয়— তিনি
ছিলেন সংগ্রাহক। বেশ কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
ও দেশ-বিদেশের বেশ কিছু আঁকা ছবির কপি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন।
তাঁর জীবনের অন্যতম
কৃতিত্ব— ‘নতুন সংস্কৃতি’ (সাহিত্য ও সংগীত বিভাগ) নামক
সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা। সচেতন এক মানবিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি এই
প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন। বাংলার সংগীতপ্রেমীদের কাছে ‘নতুন সংস্কৃতি’ এক ঝলক টাটকা বাতাস বয়ে নিয়ে এসেছিল ‘আধুনিক বাংলা কবিতার সংগীতরূপ’ অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে। আধুনিক
বাংলা কবিতার সংগীতরূপ দেওয়ার ব্যাপারে তিনিই ছিলেন পথিকৃৎ। শেষজীবনে কবি থেকে
তাঁর রূপান্তর ঘটেছিল সংগঠক হিসাবে।
কবির স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত এই ব্লগটির আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে তাঁর কথাই ধার করে বলি “এবার আবার মেলার গানে কণ্ঠ মিলাই”।
No comments:
Post a Comment